নিউজ ডেস্ক
দেশে গত আট মাসে দুই হাজারের বেশি কন্যাশিশু বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। অর্থাৎ গড়ে প্রতিমাসে বিয়ে হয়েছে ৩০৯ শিশুর। শুধু তাই নয়, একই সময়ে ৭৬ জন কন্যাশিশু যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে। এসব হয়রানি অধিকাংশই হয়েছে রাস্তা ও বাসায়। তবে সবচেয়ে ভয়াবহ তথ্য হচ্ছে ধর্ষণের। কারণ এই আট মাসে মোট ৫৭৪ কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে।
কন্যাশিশুদের নিয়ে করা এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটি করেছে ‘জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম’। বৃহস্পতিবার (২৯ সেপ্টেম্বর) প্রকাশ করা হয় এটি। প্রতিবেদনে চলতি বছরের (২০২২ সাল) জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত তথ্য দেওয়া হয়।
তথ্য সংগ্রহ করতে ২৪টি জাতীয়, স্থানীয় এবং অনলাইন পত্রিকার সহায়তা নেওয়া হয়। এছাড়া বাল্যবিয়ে সংক্রান্ত কিছু তথ্য নেওয়া হয় সরাসরি তৃণমূল অর্থাৎ মাঠপর্যায় থেকে। ১৩ ক্যাটাগরির আওতায় ৫৬টি সাব-ক্যাটাগরিতে এসব তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা হয়।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, কন্যাশিশু ও নারীর প্রতি নির্যাতনের বিষয়ে অভিযোগ জানানোর ক্ষেত্রে পারিবারিক এবং সামাজিকভাবে নানা ধরনের ভুল ধারণা, শঙ্কা ও কুসংস্কার রয়েছে। এরমধ্যে আবার নির্যাতিত শিশু বা তার পরিবার বিচার চাইতে গেলে হয়রানির শিকার হচ্ছে। যদি সব বাধা উপেক্ষা করে তারা আইনি ব্যবস্থা নিতেও যান, সেখানে আবার দেখা গেছে উল্টো চিত্র। অভিযুক্তদের আটক করা, তাদের শাস্তি প্রদান তথা ন্যায়বিচার পাওয়ার ঘটনা অনেক কম। কখনো তো বিচারই পান না ভুক্তভোগীরা।
এ বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, বিচারহীনতার সংস্কৃতির জন্য অপরাধী নির্ভয়ে অন্যায় করতে উৎসাহিত হচ্ছে। ফলে নির্যাতন ও সহিংসতা বেড়েই চলেছে।
সরাসরি মাঠ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২২ সালের প্রথম আট মাসে ২৮ জেলার বিভিন্ন উপজেলায় দুই হাজার ৪৭৪ কন্যাশিশুর বাল্যবিয়ে হয়েছে। যা গড়ে প্রতিমাসে দাঁড়ায় ৩০৯ জন। যদিও এসময় প্রশাসনের সহায়তায় তাৎক্ষণিকভাবে ৫৮৯টি বাল্যবিয়ে বন্ধ করা সম্ভব হয়েছে।
অন্যদিকে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী এই আট মাসে ১৫ কন্যাশিশুর বাল্যবিয়ে হয়েছে বলে জানা গেছে।
গণমাধ্যমে বাল্যবিয়ের সংখ্যা কমার বিষয়ে ‘জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম’ জানায়, বাল্যবিয়ের সব সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশ হয় না। আবার বেশিরভাগ বিয়ে হয় গোপনে। তাই এক্ষেত্রে শুধু গণমাধ্যমের ওপর নির্ভর না করে ফোরামের সদস্য সংগঠন থেকে মাঠপর্যায়ে গিয়ে তথ্য নেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে জানানো হয়, ২০২২ সালের প্রথম আট মাসে মোট ৭৬ কন্যাশিশু যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এদের মধ্যে আবার একজন বিশেষ শিশুও রয়েছে। এ নির্যাতনগুলোর অধিকাংশই হয়েছে রাস্তা, নিজের বাসা, নিকটতম আত্মীয় ও গৃহকর্তার দ্বারা। যৌন নির্যাতনে একটি নতুন ধরন হচ্ছে পর্নোগ্রাফি।
এদিকে মাঠপর্যায়ে মেয়ে শিশুদের সঙ্গে আলোচনা করেছে ৩৫টি গ্রুপ। আলোচনার মাধ্যমে জানা গেছে, প্রতিদিন প্রায় ৩০-৩৫ জন, আর মাসে ৯০০-
১০০০ মেয়ে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছে। সাইবার বুলিংয়ের মধ্যে রয়েছে ছবি বিকৃত করে প্রচার, অনলাইন বা ফোনে ম্যাসেজ দেওয়া ও মোবাইলে অশ্লীল ভঙ্গিমায় কথা বলা।
অন্যদিকে পত্রিকার তথ্যমতে, ২০২২ সালের প্রথম আট মাসে পর্নোগ্রাফির শিকার হয়েছে ১৫ কন্যাশিশু।
সাইবার বুলিংয়ের শিকার হওয়া অধিকাংশ শিশুই জানে না কীভাবে, কোথায়, কার সহায়তায় অভিযোগ করা যায় বা এর ফল কী হবে। এছাড়া অভিযোগের পর ব্যক্তিগত জীবন ও পারিবারিক জীবন হুমকির মুখে পড়তে পারে এ আশঙ্কায় অনেকেই মুখ খুলতে চায় না।
এদিকে চলতি বছরের আট মাসে অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছে তিন কন্যাশিশু। পারিবারিক বিবাদ, প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হওয়া, সম্পত্তি সংক্রান্ত আক্রোশ ইত্যাদি কারণে অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে।
ফোরামের প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি বছরের শুরু থেকে আগস্ট পর্যন্ত পাচারের শিকার হয়েছে ১৩৬ মেয়ে। এদের মধ্যে শিশুও রয়েছে। এর মধ্যে আবার ৭৪ জন অপহরণের শিকার হয়েছে। এই অপহরণ করা মেয়েদের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যৌনপেশায় নিয়োজিত করা হয়।
২০২২ সালের প্রথম আট মাসে যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১৩ কন্যাশিশু। এর মধ্যে যৌতুক প্রদান করতে না পারায় পাঁচজনকে হত্যা করা হয়েছে।
বর্তমানে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হলেও বেড়েই চলেছে এই অপরাধ। ২০২২ সালের প্রথম আট মাসে মোট ৫৭৪ কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এরমধ্যে একক ধর্ষণের শিকার ৩৬৪ জন, দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার ৮৪ জন। ধর্ষণের শিকারের মধ্যে প্রতিবন্ধী ৪৩ কন্যাশিশুও রয়েছে।
এছাড়া এই আট মাসে প্রেমের অভিনয় ও বিয়ের প্রলোভনে ৪৯ কন্যাশিশুকে ধর্ষণ করা হয়েছে। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২০ জনকে। এছাড়া ৮৭ শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে।
‘জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম’ বলছে, ধর্ষণের শিকার হতে হচ্ছে এক বছর বয়সের শিশুদেরও। এর মধ্যে কয়েকজন তাদের নিকটাত্মীয়ের মাধ্যমে ধর্ষিত হয়েছে। এসব শিশুরা বেড়ে উঠছে ট্রমার মধ্যে, যা তাকে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। ফলে শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তার ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অধিকার আদায় এবং সৃষ্টিশীল অবদানে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে।
চলতি বছরের প্রথম আট মাসে গৃহকর্মী নির্যাতনের ১৫টি ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে দুজনকে নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়েছে। আর আত্মহত্যা করেছে একজন।
২০২২ সালে এসে দেখা গেছে কন্যাশিশুদের মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনা বেড়েছে। আট মাসে আত্মহত্যা করেছে ১৮১ শিশু। প্রেমে প্রতারণার শিকার হয়ে ৪৬ এবং পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মনোমালিন্যের কারণে ৩৫ জন আত্মহত্যা করেছে।
অথচ ২০২১ সালের প্রথম আট মাসে আত্মহত্যা করেছিল ১৫৩ জন। অর্থাৎ ২০২২ সালে বেড়েছে আত্মহত্যার পরিমাণ।
যৌন নির্যাতন-ধর্ষণের ঘটনার কথা নির্ভয়ে প্রকাশ করার মতো কোনো আশ্রয়স্থল না থাকার বিষয়টি আত্মহত্যার প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত ১৮৬ কন্যাশিশুকে হত্যা করা হয়েছে। এর অন্যতম কারণ ছিল পারিবারিক সহিংসতা, দ্বন্দ্ব, আগে থেকে পারিবারিক শত্রুতার জের, ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের প্রমাণ না রাখার জন্য।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ দেখা গেছে, এসব অপরাধীদের অল্পসংখ্যক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক হয়। পরে এসব আটক ব্যক্তিদের অধিকাংশই জামিনে মুক্তি পায়। এরপর তারা নির্যাতিতশিশুসহ তার অভিভাবকদের বিভিন্ন হুমকি দিতে থাকে।