নিজস্ব প্রতিবেদক
জীবনের প্রতি পদক্ষেপে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছুতে পারার নামই সফলতা বা সাফল্য। সঠিক কাজটি সঠিকভাবে ও সঠিক সময়ে করে ফেলায় দেখা মিলবে সাফল্যের। সাফল্য হলো একজন মানুষ যা করতে চায় সেই বিষয়টি সবচেয়ে ভালো ভাবে করার চেষ্টা করে যাওয়া। কাজ করে যাওয়ার সাথেই সাফল্য সম্পর্কিত। পাবলো পিকাসোর মতে, কাজ শুরু করাই হলো সাফল্যের মূল চাবিকাঠি। সফল মানুষেরা সব সময়ে কাজ করে যান। তাঁরা ভুল করেন, কিন্তু কখনও সেই কারণে থেমে যান না। সাফল্য তখনই আসে যখন একজন মানুষ তার নিজের ক্ষমতার পুরোটাই কোনও কাজে বিলিয়ে দেয়। সাফল্য ঘটে না, তাকে ঘটাতে হয়। রাতারাতি সাফল্য বলতে কিছু নেই। সব সাফল্যই অনেক সময় নিয়ে আসে। সাফল্য তখনই আসে যখন একজন মানুষ তার নিজের ক্ষমতার পুরোটা কোনও কাজে বিলিয়ে দেয়। সাফল্যের আগুন একা একা জ্বলে না। এটা নিজ হাতেই জ্বালাতে হবে।
ব্যর্থতার ছাই থেকে সাফল্যের প্রাসাদ গড়তে হয়, এমনটাই মনে করতেন -ডেল কার্নেগী। তিনি বিশ্বাস করতেন, হতাশা আর ব্যর্থতা হলো সাফল্যের প্রাসাদের দুই মূল ভিত্তি। এরিস্টটলের মতে, ব্যর্থ হওয়ার নানা উপায় আছে, কিন্তু সফল হওয়ার উপায় একটাই। ব্যর্থতাই অন্যের সফলতার সোপান। হতাশা আর ব্যর্থতা হলো সাফল্যের প্রাসাদের দুই মূল ভিত্তি। উইনস্টন চার্চিল মনে করতেন, সাফল্য মানে উৎসাহ না হারিয়ে একটার পর একটা ব্যর্থতাকে টপকে যাওয়া। হেনরি ডেভিড থরোর মতে, সাফল্য তাদের কাছেই ধরা দেয় যারা এর সন্ধানে সর্বদা ব্যস্ত থাকে। অতীতের সাফল্য হয়তো কাউকে ভবিষ্যতের ব্যর্থতার দিকে নিয়ে যাবে। সাফল্যের জন্য আপনাকে তিনটি মূল্য দিতে হবে : ভালোবাসা, কঠোর পরিশ্রম, আর স্বপ্নকে বাস্তব হতে দেখার জন্য ব্যর্থতার পরও কাজ করে যাওয়া। কিন্তু যদি প্রতিটি ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নেওয়া যায়, তবে দিনশেষে একদিন সফলতার দেখা মিলবেই। জ্যাক মা বলেন, “অন্যের সাফল্যের বদলে, অন্যের ভুল থেকে শেখার চেষ্টা করো। বেশিরভাগ মানুষ মোটামুটি একই রকম কারণে ব্যর্থ হয়। অন্যদিকে সফল হওয়ার অনেক কারণ থাকতে পারে।” ফ্রান্সিস বেকনের মতে, একজনের ব্যর্থতাই অন্যের সফলতার সোপান। সফলতা লাভ করার গোপন কথাটি তাঁরাই জানেন, যারা সফলতা লাভ করেছেন। ওয়ারেন বাফেট মনে করেন, সাধারণ সফল আর অসাধারণ সফলদের মধ্যে পার্থক্য হলো, অসাধারণ সফলদের ‘না’ বলার ক্ষমতাও অসাধারণ। ভিন্স লম্বারডি যথার্থই বললেন, “সফল মানুষের সাথে অসফল মানুষের প্রধান পার্থক্য শক্তি বা জ্ঞান নয়। পার্থক্যটা হলো সত্যিকার সফল হওয়ার ইচ্ছা।” সফল মানুষেরা সাধারণত তাঁদের কাজের বিষয়কে অনেক ভালোবাসেন। সফল হওয়ার চেষ্টা করার বদলে দক্ষ হওয়ার চেষ্টা করলে সফলতা নিজ থেকেই ধরা দেবে। তাঁরাই সবচেয়ে বেশি সফল, যারা তাঁদের সবচেয়ে ভালোলাগার কাজটি করছে। অন্যরা ছেড়ে যাওয়ার পরও দীর্ঘ সময় হাল ধরে রাখতে পারা সাফল্য অর্জন করার জন্য খুব বড় একটা ব্যাপার। একজন মানুষ এখন কতোটা উপরে আছে, তা দিয়ে তাঁর সাফল্য মাপা উচিত নয়। একদম নিচে পড়ে যাওয়ার পর সে নিজেকে কতোটা উপরে তুলতে পেরেছেন, সেটাই আসল কথা। প্রত্যেকের জীবনের একটা গল্প আছে। অতীতে ফিরে গিয়ে গল্পের শুরুটা কখনো পরিবর্তন করা সম্ভব নয়, কিন্তু কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে গল্পের শেষটা চাইলেই নতুন করে সাজিয়ে তোলা যায়।
যতক্ষণ ভালো লাগে সাধারণ মানুষ ততক্ষণ কাজ করেন। আর অসাধারণ সফল মানুষেরা ভালো না লাগলেও যতক্ষণ কাজ শেষ না হয়, ততক্ষণ কাজ বন্ধ করেন না। সাফল্যের মূল্য হলো হাতের কাজের প্রতি ভালোবাসা আর কঠোর পরিশ্রম। নেলসন ম্যান্ডেলা বিশ্বাস করেন, প্রত্যেকেই নিজ নিজ পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির ঊর্ধ্বে উঠতে পারে এবং সাফল্য অর্জন করতে পারে, যদি সে যা করছে তার প্রতি নিবেদিতপ্রাণ ও সত্যিকারের আন্তরিক হয়। উইলিয়াম ল্যাংয়েড মনে করেন, যেখানে পরিশ্রম নেই, সেখানে সাফল্য নেই। কারো মেধার ঘাটতি থাকতে পারে, কিন্তু, পরিশ্রম দিয়ে মেধার ঘাটতি অবশ্যই পুষিয়ে নেওয়া যায়। সেই সাথে, জয়-পরাজয় ভুলে নিজের পুরো সামর্থ বিলিয়ে দেয়া। ডেল কার্নেগীর মতে, যার মাঝে সীমাহীন উৎসাহ, বুদ্ধি ও একটানা কাজ করার গুণ থাকে, তার সফল হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। সাফল্য অর্জন করা আর সফল হওয়া এক নয়। সুবিধা পেলে অনেকেই সফল হতে পারেন। অনেককে জোর করে সফল বানানোও হয়। কিন্তু যিনি নিজের চেষ্টা আর পরিশ্রম দিয়ে সফল হন – তিনিই প্রকৃত সাফল্য অর্জন করেন। সাফল্য চাইলে সাফল্যকে লক্ষ্য বানানো যাবে না; মন যা করতে ভালোবাসে, সেটাই করতে থাকা উচিত, সাফল্য নিজেই ধরা দেবে। সফলতা সুখের চাবিকাঠি নয়, বরং সুখ হল সফলতার চাবিকাঠি। আপনার কাজকে যদি আপনি মনে প্রাণে ভালোবাসতে পারেন অর্থাৎ আপনি যদি নিজের কাজ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকেন তবে আপনি অবশ্যই সফল হবেন।
সব সাফল্যই অনেক সময় নিয়ে আসে। সহজে জেতার আনন্দ কোথায়? কোনও কিছু করার আগ পর্যন্ত সবসময়ই সেটা অসম্ভব বলে মনে হয়। বাধা যত বিশাল, বিজয়ের আনন্দও ততোই বাঁধভাঙ্গা! বিল গেটসের মতে, ধৈর্য্যই হলো সাফল্যের প্রধান শর্ত। স্টিভ জবস বলেন, “রাতারাতি সাফল্য বলতে কিছু নেই। মনোযোগ দিলে দেখবে সব সাফল্যই অনেক সময় নিয়ে আসে।” জীবন মানে নিরন্তর ছুটে চলা। পদে পদে বাধা-বিপত্তি, প্রতিকূলতায় রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত হওয়া, সে ক্ষত মুছে আবার প্রবল আগ্রাসে ঝাঁপিয়ে পড়ার মাঝেই আসে সাফল্য। সংগ্রাম এবং সাফল্য – এই তো জীবন! যখন সাফল্য আসে, তখন যন্ত্রণাকে আর যন্ত্রনা মনে হয় না। সংশয় যেখানে থাকে, সাফল্য সেখানে ধীর পদক্ষেপে আসে। কখনও ভেঙে পড়া উচিত নয়। পৃথিবীর যা কিছু হারিয়ে যায়, অন্য কোনো রূপে সেটি ঠিকই আবার ফিরে আসে জীবনে। সম্ভাবনা আর বিপদ হাতে হাত রেখে চলে। তাই বলে সম্ভাবনার দ্বার না খুললে কি চলবে? কখনো হাল ছেড়ে দিতে নেই। এখনকার এই দাঁতে দাঁত চেপে করা কষ্টগুলোই বিজয়ীর খেতাব দেবে সারাজীবনের জন্য। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এ.পি.জে আব্দুল কালাম বলেন, “মানুষের জীবনে কঠিন সময় আসাটা খুব দরকার। কঠিন সময়ের কারণেই মানুষ সাফল্য উপভোগ করতে পারে।” যেখানে পরিশ্রম নেই, সেখানে সাফল্যও নেই। কাউকে তার সফলতা দ্বারা বিচার করা উচিত নয়, বরং ব্যর্থতা থেকে কতবার সে ঘুরে দাঁড়িয়েছে তা দিয়ে তার সাফল্যকে বিচার করা উচিত। নেলসন ম্যান্ডেলা কী বললেন শুনুনঃ “আমাকে আমার সফলতা দ্বারা বিচার করো না; ব্যর্থতা থেকে কতবার আমি ঘুরে দাঁড়িয়েছি তা দিয়ে আমাকে বিচার করো।” অনুশীলন মানুষকে পারদর্শী করে তোলে। মাও সে তুং প্রায়শই বলতেন, “সন্তানের সাফল্য চাইলে তাকে মাছ খেতে দেয়ার বদলে মাছ ধরতে শেখাও।” সন্তানের সাফল্য চাইলে তাকে মাছ খেতে দেয়ার বদলে মাছ ধরতে শেখাতে হবে। আলবার্ট আইনস্টাইন বলেন, “সফল হওয়ার চেষ্টা করার বদলে দক্ষ হওয়ার চেষ্টা করো। সাফল্য এমনিই আসবে।” জীবনে যিনি হাজার হাজার ভুল করেছেন, হাজারবার হোঁচট খেয়েছেন সেটি নিয়ে তাঁর লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। প্রত্যেকটি ভুল, প্রত্যেকবার হোঁচট খাওয়া তাঁকে গড়ে তুলতে পারে আরও শক্তিশালী, আরও পরিণত করে। লক্ষ্যের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেও যখন ব্যর্থতার তিক্ত স্বাদ পেতে হয়- তাতে দুঃখের কিছু নেই। এই কঠোর পরিশ্রমের ভেতর দিয়ে আপনি হয়ে উঠেছেন আরো শক্তিশালী, আরো অভিজ্ঞ, আরো দক্ষ- এটাই তো সত্যিকারের বিজয়!
সব মানুষই চায় জীবনে সফল হতে । কিন্তু সবাই সফল হতে পারেন না। এমনকি জ্ঞান, বুদ্ধি, বিদ্যা ও সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বেশির ভাগ মানুষ সফলতার শিখরে পৌঁছতে পারেন না । এর অন্যতম কারণ হল বেশির ভাগ মানুষ নিজেই জানেন না তার ভেতরে কতটা সম্ভাবনা আছে বা তিনি কী করতে পারেন । আর বাকি কারণ হল চেষ্টা, আত্মবিশ্বাস, ধৈর্য, সাফল্যের জন্য ক্ষুধা ইত্যাদির অভাব। আমেরিকান দার্শনিক ও মনোবিজ্ঞানী উইলিয়াম জেমস বলেন, “একজন মানুষের সফল বা ব্যর্থ হওয়া তার ক্ষমতার ওপর যতটা না নির্ভর করে, তারচেয়ে বেশি তার দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভর করে। যারা সফল হয়, তারা সফল হওয়ার আগে থেকেই সফল মানুষের মত আচরণ করে। এই বিশ্বাসই একদিন সত্যিতে পরিনত হয়। আপনি যদি বিশ্বাস করেন যে আপনি অবশ্যই সফল হবেন, তবে আপনার ব্যবহারেও তা প্রকাশ পাবে। এবং আপনি নিজেই নিজের এই দৃষ্টিভঙ্গির সুফল দেখে অবাক হয়ে যাবেন।” আশাবাদিতা হল এক ধরনের বিশ্বাস, যা মানুষকে সাফল্যের দিকে পরিচালিত করে। আশা এবং আত্মবিশ্বাস ছাড়া কোনো কিছুই সম্ভব নয়। মার্ক টোয়েনের মতে, জীবনে সফল হতে চাইলে দু’টি জিনিস প্রয়োজন: জেদ আর আত্মবিশ্বাস। তাই বলি, সফলতার স্বপ্নকে ত্যাগ করে নয়, তাকে সঙ্গে নিয়ে চলতে হবে। কারণ, সাফল্যের স্বপ্ন ছাড়া জীবন অর্থহীন। আত্মশক্তির প্রতি যার শ্রদ্ধা আছে, সে একদিন যতো বিলম্বেই হোক না কেন গগনমার্গে মস্তক উঁচু করে দাঁড়াবেই। যদি আপনার লক্ষ্য যথেষ্ট দৃঢ় হয়, তাহলে ব্যর্থতা কখনও আপনাকে দমিয়ে রাখতে পারবে না। এ-ই প্রসঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দ বলেন, “একটি লক্ষ্য ঠিক করো। সেই লক্ষ্যকে নিজের জীবনের অংশ বানিয়ে ফেলো। চিন্তা করো, স্বপ্ন দেখো। তোমার মস্তিষ্ক, পেশী, রক্তনালী ও পুরো শরীরে সেই লক্ষ্যকে ছড়িয়ে দাও, আর বাকি সবকিছু ভুলে যাও। এটাই সাফল্যের পথ।” জন উডেনের সাথে একমত হয়ে বলতে চাই, সাফল্য তখনই আসবে যখন একজন মানুষ তার নিজের ক্ষমতার পুরোটা কোনও কাজে বিলিয়ে দেবে। আমি মনে করি, পৃথিবীটা হচ্ছে একটি আয়নার মতো- আমরা সবার সাথে যেমন ব্যবহার করবো, সবাইকে নিয়ে যেমন মনোভাব পোষণ করবো, প্রতিদানে ঠিক তেমনটাই ফিরে পাবো। বিশাল মহাজগতে ক্ষুদ্র বালুকণার চেয়ে ছোট্ট এ পৃথিবী, তার মাঝে ক্ষণিকের এ জীবন ও জগতের বুকে একটি আঁচড় না কেটেই হারিয়ে যাবে অতলে? ঘুমিয়েই কি কেটে যাবে একটি জীবন? অতীতকে পরিবর্তন করা সম্ভব নয়, কিন্তু ভবিষ্যৎ এখনও আমাদের হাতে। অনাগত নতুন দিনই নতুন শক্তি এবং নতুন দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দেবে এই বিশ্বাস নিয়েই পথ চলতে হবে। বাঁচার মতো বাঁচতে জানলে জীবনটা অসম্ভব রোমাঞ্চকর একটি অভিযান, আর একদম ঝুঁকিহীন জীবন সে তো মুরগির খোঁয়াড়ে ধুঁকে ধুঁকে টিকে থাকা। জীবনকে করতে হবে কর্মচাঞ্চল্যে ভরপুর, ছুটে চলার নিরন্তর অনুপ্রেরণায় ভরিয়ে দিতে হবে জীবনের প্রতিটি মুহুর্ত। বিশ্রাম নেওয়ার জন্য কবরের অনন্ত জীবন চিরকাল পড়ে রয়েছেই। পৃথিবীর সবচেয়ে আনন্দের অনুভূতিটি হচ্ছে, যখন কেউ একটি লক্ষ্য ঠিক করেছিলেন আর জীবন-সায়াহ্নে এসে হলেও সেই লক্ষ্যটি তিনি পূরণ করতে পারলেন! জীবনের সূর্যটা ডোবার আগেই কিছু সাফল্য রেখে গিয়ে এই পৃথিবীর ঋণ কিছুটা হলেও শোধ করে যাওয়া উচিত যেন মৃত্যুর পর পৃথিবীর বর্তমান আর অনাগত মানুষেরা অন্তত একটা সফল কল্যাণকর কর্মের জন্য হলেও আমাদেরকে একটা বার স্মরণ করে। তাহলেই মিলবে জীবনের আসল সফলতা।