ঝুমকি বসু, স্বত্তাধিকারী-রুপসা।
ছকে বাঁধা জীবনে কেউ কেউ বড্ড হাঁপিয়ে ওঠে। নিজের পছন্দসই জীবন সাজাতে না পারার হাপিত্যেশ রয়েই যায়। তাই নয়টা পাঁচটার জীবনে সাফল্য থাকলেও মন যেন খুঁজে চলে অন্য কোনো কিছু। একান্তই নিজের কিছু। সেই ভাবনা থেকেই উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলাম আমি।
এইচএসসির পর পড়াশোনার জন্য চলে যাই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে পড়ার পর স্নাতকোত্তর করি ঢাকায়। উদ্ভিদবিজ্ঞান নিয়ে পড়ার পাশাপাশি চলে আইন নিয়ে পড়াও। আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হই। এরমধ্যে বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অফিসে চাকরি শুরু করি। পাঁচ বছর চাকরি করার পর আমার সন্তানের জন্ম হয়। চাকরি করা আর সম্ভব হয়ে ওঠে না। ইতোমধ্যে বুঝতে পারি সংসার-সন্তান সামলে বাসার বাইরে গিয়ে চাকরি করা আর হবে না। কিন্তু একটা কিছু করার ইচ্ছে অনবরত মনে নাড়া দিতে থাকে। ছেলে আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে। বড় হতে থাকে মনের সুপ্ত ইচ্ছেটাও। একদিন বাজারে কেনাকাটা করতে গিয়ে কিছু কাঠের নকশা এবং রং কিনে আনি। ভেবেছিলাম সামনে ছেলের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে নিজের হাতে তৈরি করা গয়না পরবো। পরার পর ওই অনুষ্ঠানে পেলাম সবার প্রশংসা। সাহস সেদিন বেড়ে গেল। ফেসবুকে একটা পেজ খুলে ফেললাম। জন্ম নিল ‘রূপসা’। সময়টা ছিল মে ২০১৯।
প্রথমে কাজ শুরু করি হাতে তৈরি বিভিন্ন গয়না দিয়ে। এরপর নিজে ডিজাইন করে শাড়ি, পাঞ্জাবি, ব্লাউজ পিস করতে শুরু করলাম। অনলাইনে বিক্রির পাশাপাশি মেলাতে অংশ নিয়েও ব্যাপক সাড়া পেয়েছি। জয়িতার একজন নিবন্ধিত উদ্যোক্তা আমি। স্বপ্ন ছিল রূপসা’র পণ্য দেশ ছাপিয়ে বিদেশেও দাপিয়ে বেড়াবে। বছর দুই ধরে ইউরোপ আমেরিকাতেও যেতে শুরু করেছে রূপসার পণ্য।
নারীর জন্য চাকরি করা কত কষ্টের তা আমি আমার জীবন দিয়ে বুঝেছি। পারিবারিক সাপোর্ট না থাকলে সন্তান মানুষ করার সঙ্গে সঙ্গে চাকরি করা সম্ভব হয় না। কিন্তু ব্যবসা আমার নিজের। এখানে সময়ের সীমাবদ্ধতা নেই। তাই আমি সন্তানকে স্কুলে দিয়ে আমার বিভিন্ন প্রোডাক্ট রেডি করি, ওকে ঘুম পাড়িয়ে ব্যবসার কাজ করি। মোটকথা আমি আমার মতো করে সময়টা বের করে নিচ্ছি। যে সুযোগ চাকরিতে নেই। নিজে কাজ করার পাশাপাশি কয়েকটা প্রশিক্ষণ নিয়েছি। প্রশিক্ষণে অনেক বিষয় জানা যায়। ছোট ছোট ভুল-ত্রুটিগুলো শুধরে নেওয়া যায়।
ব্যবসার কথা যখন পরিবারের সদস্যরা প্রথম জানলেন, তাদের সাপোর্ট ছিল না। আমার মা প্রথমে শুনেই বললেন এত পড়ালেখা করে শেষে তুই গয়না বানাবি? খুব মন খারাপ হয়েছিল। কিন্তু দমে যাইনি। পূজার সময় আমি নিজে ডিজাইন করে বাড়ির সবাইকে শাড়ি, পাঞ্জাবি, ফতুয়া, ব্লাউজ, গয়না বানিয়ে দিলাম। পরিবারের সবাই খুব প্রশংসা করলেন। আশেপাশের মানুষদেরও সমাদর পেলাম। ফেসবুক পেজের চাপও বাড়তে লাগলো। তখন পরিবারের সবাই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন।
রূপসা আমার সন্তানের মতো। প্রায় চার বছরের উদ্যোক্তা জীবনে আমি নিজের অবস্থানে খুশি। কিন্তু সবাই চায় তার সন্তান আরও বড় হোক, আরও নাম করুক। তেমনি আমিও চাই আমার রূপসা আরও এগিয়ে যাক। অনেকেই বলে রূপসা কি আমার মেয়ের নাম? আমি বলি হ্যাঁ, রূপসা আমার মেয়ে। আমার মেয়ে রূপসাকে আমি প্রতিনিয়ত গড়ে তুলছি পরম মমতায়। আজ যেমন রূপসাকে সবাই পছন্দ করে, ভালোবাসে সে সুনাম যেন সবসময় থাকে, সেটা আমি মাথায় রাখি।
উদ্যোক্তা হতে হলে অনেক নেগেটিভ কথা শুনতে হয়। বিশেষ করে প্রথম দিকে। কিন্তু সেসব শুনে পিছিয়ে পড়লে বা মন খারাপ করলে চলবে না। নিজের স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে নিজের মতো করেই। ধৈর্য ধরে ভালো কাজ করে যেতে পারলে সফলতা আসবেই- এই নীতি নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে আমার রূপসা।