নিউজ ডেস্ক
বেশির ভাগ যুব নারী-পুরুষ জেন্ডার সমতার বিষয়ে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করেন। তাঁদের এই মনোভাব বদলাতে শিক্ষা বড় ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ, শিক্ষিতদের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাব কম।
আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস উপলক্ষে রাজধানীর মহাখালীতে ব্র্যাক সেন্টারে ব্র্যাক আয়োজিত এক সংলাপে এসব কথা বলেন বক্তারা। এতে ‘বাংলাদেশের তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে জেন্ডার আচরণগত মনোভাব অন্বেষণ’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়, যেখানে যুব নারী-পুরুষদের নেতিবাচক মনোভাব ও তা দূর করতে শিক্ষার ভূমিকার দিকটি উঠে আসে। ব্র্যাকের ‘অ্যাডভোকেসি ফর সোশ্যাল চেঞ্জ’ বিভাগ গত বছরের নভেম্বর থেকে এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত দুই ধাপে গবেষণাটি পরিচালনা করে। প্রথম ধাপে চার জেলার ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী ১২৮ জন এবং দ্বিতীয় ধাপে আটটি জেলার একই বয়সসীমার ২ হাজার ৭৯০ জনের ওপর জরিপটি করা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাগত ও কাউন্সিলিং মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মেহ্জাবীন হকের নেতৃত্বে গবেষণা দলে আরও ছিলেন একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. আজহারুল ইসলাম ও ন্যাশনাল একাডেমি ফর নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅ্যাবিলিটির সহকারী অধ্যাপক (মনোবিজ্ঞান) মোহাম্মদ সেলিম চৌধুরী।
গবেষণায় উঠে আসে যে পোশাকের কারণে নারীরা ধর্ষণ ও যৌন হেনস্তার শিকার হন বলে মনে করেন ৬৩ শতাংশ যুব নারী-পুরুষ। ৮২ শতাংশ মনে করেন, নারীদের জোরে কথা বলা উচিত নয়। স্বামীর উপার্জন যথেষ্ট হলে নারীর আয় করার প্রয়োজন নেই বলে মনে করেন ৭৫ শতাংশ। সংসারের ব্যয়ের বিষয়ে পুরুষের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে মনে করেন ৭১ শতাংশ।ব্র্যাক সংলাপে গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করেন অধ্যাপক মেহ্জাবীন হক। প্রতিবেদনে
আরও বলা হয়, যুবদের ৭৭ শতাংশ মনে করেন, রাগ শুধু ছেলেদের থাকবে। ৪৯ শতাংশ মনে করেন, নারীরা যৌন আকাঙ্ক্ষার বিষয়টি প্রকাশ করতে চান না, ছেলেদের উচিত জোর করা। ৫১ শতাংশ মনে করেন, নারীর চেয়ে পুরুষের চাকরিতে অধিকার বেশি থাকা উচিত। নারী-পুরুষের মধ্যে ঋণ যিনিই পান, সেই টাকা খরচে পুরুষের কথাই চূড়ান্ত হওয়া উচিত বলে মনে করেন ৬৮ শতাংশ। নারীরাও অনেক ক্ষেত্রে পুরুষতন্ত্রে বিশ্বাসে আক্রান্ত।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, জেন্ডার সমতার বিষয়ে যুবদের বেশির ভাগের যে মনোভাব, তা ঠিক নয়। যেমন পোশাক ধর্ষণের কারণ হতে পারে না। তাহলে শিশুরা ধর্ষণের শিকার হতো না।শহরে বড় হওয়া যুব জনগোষ্ঠীর মধ্যে অসমতার মনোভাব গ্রামে বড় হওয়া যুবদের চেয়ে তুলনামূলক কম বলে উঠে আসে গবেষণায়। এতে আরও বলা হয়, ব্যক্তির শিক্ষা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মা-বাবার শিক্ষা কতটুকু, কোন পরিবেশে বড় হয়েছে—তার ওপর যুবদের সমতার ভাবনা প্রভাবিত হয়। যাঁরা উচ্চমাধ্যমিক ও এর বেশি পড়াশোনা করেছেন, তাঁদের মধ্যে সমতার ভাবনা তুলনামূলক বেশি।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেন, নারী-পুরুষের মধ্যে সমতার মনোভাব গড়ে তুলতে শিক্ষা বড় ভূমিকা রাখে বলে নতুন শিক্ষা কার্যক্রমে এ বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এই শিক্ষা কার্যক্রম পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পারলে ১০ বছর পর নারী-পুরুষের সমতার বিষয়ে ভাবনায় বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে। তিনি বলেন, রাজনীতির মাধ্যমেই নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, জেন্ডার সমতার ক্ষেত্রে শুধু আচরণগত সমস্যা নয়, নীতিগত সমস্যাও আছে। যে শিক্ষক শেখাবেন, সেই শিক্ষককেও জেন্ডার সমতার বিষয়ে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির হতে হবে।
মহিলা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ফরিদা পারভীন বলেন, জেন্ডার সমতার বিষয়ে বাংলাদেশে অনেক পরিবর্তন এসেছে। বাংলাদেশ এখন অনেক দেশের জন্য অনুকরণীয়।
নতুন শিক্ষা কার্যক্রমে আশার আলো রয়েছে বলে উল্লেখ করেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ।
ইমামদের মাধ্যমে সমাজে সমতার বার্তা সহজে পৌঁছানো যায় উল্লেখ করে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, ইমামদের আরও প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, শিক্ষিত অনেক পরিবার বিয়ে হয়ে যাবে—এই অজুহাতে মেয়েসন্তানের ওপর বিনিয়োগ করতে চায় না।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, জেন্ডার সমতা নিয়ে যাঁরা নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন, বিভিন্ন আলোচনায় তাঁদের যুক্ত করলে ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে।
সমতার ইতিবাচক মনোভাব গড়ে তুলতে বিভিন্ন স্তরে কাজ করার ওপর জোর দেন ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ। তিনি বলেন, কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে বেসরকারি সংস্থাগুলো ঠিক কোন কোন ক্ষেত্রে কী সহযোগিতা করতে পারে, তা সরকার জানালে ভালো হয়।
ব্র্যাকের জ্যেষ্ঠ পরিচালক (অ্যাডভোকেসি, ইনোভেশন অ্যান্ড মিল) কে এম মোর্শেদ বলেন, যুবদের নিয়ে কোনো উন্নয়ন কর্মসূচি নেওয়ার জন্য পরিকল্পনা করার আগে জানা দরকার যুবরা আসলে কী ভাবছেন।
সংলাপের সঞ্চালক ব্র্যাকের পরিচালক (জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভার্সিটি) নবনীতা চৌধুরী বলেন, যুবরা কী মনোভাব পোষণ
করছেন, তা জানতে পারলে যথাযথ পরিকল্পনার মাধ্যমে নেতিবাচক বিষয়গুলো সারিয়ে তোলা সম্ভব হবে।
অনুষ্ঠানে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন ব্র্যাকের কর্মসূচি প্রধান (অ্যাডভোকেসি) এস এম মনজুর রশীদ। আরও বক্তব্য দেন জাগো ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা করভী রাখসান্দ, ব্র্যাক ইয়ুথ প্ল্যাটফর্মের দুই তরুণ অরুনিমা তাহসিন ও শাহরিয়ার কবির।